শিক্ষা ব্যবস্থায় সংকট: শূন্যপদ, ড্রপআউট ও বিশেষজ্ঞদের মতামত
সংসদীয় কমিটির রিপোর্ট
সংসদের চলতি বাদল অধিবেশনে শিক্ষা বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটি তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট উপস্থাপন করেছে। সেখানে জানানো হয়েছে, দেশজুড়ে স্কুল শিক্ষার স্তরে ১০ লক্ষাধিক শিক্ষকের পদ খালি রয়েছে। কেন্দ্রীয় বিদ্যালয় ও নবোদয় বিদ্যালয়গুলিতেও একই ছবি দেখা যাচ্ছে।
স্থায়ী নিয়োগের পরিবর্তে অস্থায়ী বা চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক নিয়োগের প্রবণতা বাড়ছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে শুধু শিক্ষার মানই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, তপশিলি জাতি ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির চাকরিপ্রার্থীরাও বঞ্চিত হচ্ছেন।
কংগ্রেস সাংসদ দিগ্বিজয় সিং-এর নেতৃত্বে গঠিত কমিটি সুপারিশ করেছে— দ্রুত শূন্যপদ পূরণ, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল, এবং শিক্ষানীতি নিয়ে পুনর্বিবেচনা। কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ সামাজিক মাধ্যমে এসব প্রস্তাব শেয়ার করেছেন। এছাড়া বিএলএড (Bachelor in Elementary Education) কোর্স চালু রাখার পক্ষে মত দিয়েছে কমিটি, কারণ এই কোর্স দীর্ঘদিন ধরে দক্ষ শিক্ষক তৈরিতে সহায়ক।
ইউনেস্কোর তথ্য
২০২১ সালে ইউনেস্কো প্রকাশিত এক সমীক্ষায় জানানো হয়েছিল, ভারতের প্রায় ১৯ শতাংশ শিক্ষকের পদ ফাঁকা। গ্রামীণ এলাকায় এই সংকট আরও মারাত্মক— প্রায় ৬৯ শতাংশ শূন্যপদ। উত্তরপ্রদেশ, বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের মতো জনবহুল রাজ্যগুলোতে শূন্যপদের সংখ্যা ছিল অত্যন্ত বেশি। এমনকি অনেক স্কুলে মাত্র একজন শিক্ষক দিয়ে পঠনপাঠন চালানোর ঘটনাও নজরে আসে।
আইন থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন
২০০৯ সালে শিক্ষার অধিকার আইন, ২০১৪ সালে চাইল্ডহুড কেয়ার অ্যান্ড এডুকেশন অ্যাক্ট এবং ২০২০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি চালু হলেও বাস্তবে স্কুলশিক্ষার মান তেমন উন্নত হয়নি। স্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ না হওয়ায় বহু স্কুলে ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত নেমে এসেছে ন্যূনতম পর্যায়ে। ফলে ড্রপআউট বাড়ছে, এমনকি অনেক স্কুল কার্যত শিক্ষকবিহীন অবস্থায় চলছে।
পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপট
কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গেও উল্লেখযোগ্য শূন্যপদ রয়েছে। প্রতিবছর শিক্ষা মিশনের বাজেট বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়। তবে ড্রপআউটের সংখ্যাকে ঘিরে ধোঁয়াশা রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন, কন্যাশ্রী প্রকল্প স্কুলছুটের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়েছে। প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক স্তরে মেয়েদের ড্রপআউট হার শূন্যতে নেমে এসেছে বলেও তিনি জানান।
তবে নারী আন্দোলন কর্মীরা বলছেন, কন্যাশ্রী ও ট্যাব পাওয়ার মতো সুবিধার জন্য অনেকে স্কুলে ভর্তি হলেও শেষ পর্যন্ত পরীক্ষায় বসে না। ইউনিসেফের রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজ্যে নাবালিকা মায়ের সংখ্যা বাড়ছে, যা শিক্ষার ক্ষেত্রে আরেকটি চ্যালেঞ্জ।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
শিক্ষাবিদ মিরাতুন নাহার মনে করেন, সরকার শিক্ষাকে ক্রমে বাণিজ্যিকীকরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তার ভাষায়, “শিক্ষা নয়, দেওয়া হচ্ছে প্রতিষ্ঠান; ফলে দরিদ্র পরিবারগুলোর সন্তানরা মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।”
বঙ্গীয় প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আনন্দ হান্ডা বলেছেন, ২০২০ সালে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী দেশে এক কোটিরও বেশি স্কুলে মাত্র একজন শিক্ষক দিয়ে ক্লাস চলছে। এর মধ্যে প্রায় ৮৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। গত পাঁচ বছরে এ অবস্থার তেমন কোনো উন্নতি হয়নি বলে তিনি জানান।
আশার আলো
সব প্রতিকূলতার মধ্যেও আশার খবর রয়েছে। সমাজকর্মী শাশ্বতী ঘোষের মতে, “এখন অনেক মেয়ে বিয়ের পরিবর্তে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চায়। অনেকেই প্রশাসনের সাহায্য নিচ্ছে, যা ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক দিক।”